
আতিকুর রহমান:-
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে—চরম রাজনৈতিক সংকট, জনরোষ, অর্থনৈতিক দুরবস্থা কিংবা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অনেক রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান ক্ষমতা হারিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। কারো কারো এই দেশত্যাগ ছিলো গোপন ও নাটকীয়, আবার কারো কারো ছিলো প্রকাশ্য ও বিতর্কিত। নিচে তেমনি কিছু রাষ্ট্রপ্রধানের সংক্ষিপ্ত তালিকা তুলে ধরা হলো:
🇧🇩 বাংলাদেশ: শেখ হাসিনা
বর্তমানে বাংলাদেশে টানা ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা।তার সরকারের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন, স্বৈরাচারী আচরণ ও ভোটবিহীন নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি সমালোচনার ছিল। এরপর ২০২৪ সালে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে ওই বছরের ৫ আগষ্ট তিনি দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হন।
🇨🇦 কানাডা: জাস্টিন ট্রুডো
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নানা দুর্নীতির অভিযোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জনমনে হতাশার কারণে তাঁকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে তিনি ২০২৫ সালে পদত্যাগ করেন।
🇸🇾 সিরিয়া: বাশার আল-আসাদ
২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাশার আল-আসাদের পদত্যাগ ও দেশত্যাগ দাবি ওঠে। এরপর তিনি ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হন।
🇱🇰 শ্রীলঙ্কা: গোতাবায়া রাজাপাকসে
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে জনরোষের মুখে পড়ে গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশত্যাগ করেন। প্রথমে তিনি মালদ্বীপ ও পরে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যান। এটি ছিল এশিয়ার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় দেশত্যাগ।
🇦🇫 আফগানিস্তান: আশরাফ ঘানি
২০২১ সালে তালেবান কাবুল দখল করলে প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি কোন প্রতিরোধ গড়ে না তুলে রাতের আঁধারে কাবুল ছেড়ে পালিয়ে যান। তিনি পরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। তাঁর এই আচরণে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে।
🇵🇰 পাকিস্তান: পারভেজ মোশাররফ
সাবেক সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতা হারানোর পর দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। নানা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে তিনি চিকিৎসার অজুহাতে দেশত্যাগ করেন এবং শেষ পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতে থেকেই মৃত্যুবরণ করেন।
🇮🇩 ইন্দোনেশিয়া: সোহার্তো
দীর্ঘ ৩১ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার পর ১৯৯৮ সালে দুর্নীতি ও গণবিক্ষোভের মুখে ইন্দোনেশিয়ার স্বৈরশাসক সোহার্তো পদত্যাগে বাধ্য হন। পরে তিনি গোপনে পরিবারসহ দেশ ছাড়েন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলারের দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।
🇭🇹 হাইতি: অ্যারিস্টাইড
দু’বার হাইতির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েও সামরিক অভ্যুত্থানে অপসারিত হন অ্যারিস্টাইড। ২০০৪ সালে মার্কিন হস্তক্ষেপে তাকে জোরপূর্বক দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তিনি পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় আশ্রয় নেন।
🇸🇩 সুদান: সাদিক আল-মাহদি
১৯৮৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান সুদানের প্রধানমন্ত্রী সাদিক আল-মাহদি। তিনি পরে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য বিদেশে চলে যান। দীর্ঘ সময় পর দেশে ফিরেও আর রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারেননি।
🇮🇷 ইরান: মোহাম্মদ রেজা পাহলভি (শেষ শাহ)
ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা হারান এবং দেশত্যাগে বাধ্য হন। তিনি একাধিক দেশে ঘুরে মিশরে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই মারা যান। এটি ছিল ২০ শতকের সবচেয়ে আলোচিত দেশত্যাগের একটি।
পরিশেষে এই তালিকা থেকে বোঝা যায়, রাজনৈতিক সংকট ও গণআন্দোলনের মুখে বিশ্বের যেকোনো ক্ষমতাধর নেতা যেকোনো সময়েই পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হলে দেশত্যাগে বাধ্য হতে পারেন। ইতিহাস প্রমাণ করে—
জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয় না।