
মেহেন্দিগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
শিশু ধর্ষণ—একটি শব্দই সমাজকে শিহরিত করার জন্য যথেষ্ট। অথচ এমন ভয়াবহ অপরাধকে ধামাচাপা দিতে যখন স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সক্রিয় ভূমিকা রাখেন, তখন ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা ভেঙে পড়ে। মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার কাজিরহাট থানার ভাষানচর ইউনিয়নের খলিসার উত্তরপাড় গ্রামে সম্প্রতি এমন এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে।
প্রায় দুই মাস আগে মৃত কাশেম হাওলাদারের ছেলে মোশারফ হাওলাদার (৫৫) (পার্শ্ববর্তী কবিরাজ বাড়ির নাতনি) প্রতিবেশী ১১ বছরের এক শিশুকে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে বাড়ির পাশে নির্জন পুকুরপাড়ে ডেকে নেয়। পরে শিশুটির মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে ধর্ষণ করে। আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় শিশুটিকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হলেও ঘটনাটি পুরোপুরি গোপন থাকে। ভিকটিমের স্বামী পরিত্যক্তা মা ফাতেমা বেগম সাহস করে মামলা করতে চাইলে বাঁধা দেন স্থানীয় ইউপি সদস্য কাইয়ুম চারু। এরপর তিনি ইসমাইল চারু, বেল্লাল চারু, মিলন, রায়হানসহ কয়েকজনকে নিয়ে গোপনে এক সালিশি বৈঠক বসান। সেখানে অভিযুক্ত মোশারফ হাওলাদারের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩০ হাজার টাকা ভিকটিমের মাকে দেওয়া হয়, আর বাকি টাকা ভাগ করে নেয় শালিসকারী মহল।
অভিযোগ রয়েছে, পরবর্তীতে ভিকটিম ও তার মাকে কৌশলে এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক ভিডিওতে (খলিসার দক্ষিন পাড় মডেল স্কুল সংলগ্ন ব্রীজের পাশে রাজ্জাকের চায়ের দোকান) চায়ের আড্ডায় স্থানীয় মতলেব চারুর কণ্ঠে এই শালিস ও অর্থ লেনদেনের তথ্য উঠে আসে। ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেন—”অপরাধীরা টাকায় সব কিনে নিতে পারলেও শিশুটির ভবিষ্যৎ কে ফিরিয়ে দেবে?” সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ঘটনার পর থেকে শিশুটি ও তার মায়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নানাবাড়ির স্বজনরা জানাচ্ছেন, তারা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, এমনকি জীবিত আছেন কি না—তা নিয়েও তারা শঙ্কিত। অনেকের ধারণা, প্রভাবশালী মহল তাদের গুম করে রেখেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ইউপি সদস্য কাইয়ুম চারু দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে আসছেন।
অতীতে তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য পংকজ নাথের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বর্তমানে রাজনৈতিক পালাবদলের পর যুবনেতা দাবী করে আগের মতোই দাপট দেখাচ্ছেন। শিশু ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধকে ‘শালিসের নামে ধামাচাপা’ দেওয়া তার প্রভাবেরই প্রমাণ বলে মনে করছেন সচেতন মহল। ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত মোশারফ হাওলাদার দাবি করেছেন, জমিজমা নিয়ে ভিকটিমের মায়ের সঙ্গে বিরোধ ছিল। সেটি তার ভাতিজা (র্যাব সদস্য) কবির হাওলাদার ও ইউপি সদস্য কাইয়ুম চারু মিলে মীমাংসা করে দিয়েছেন।
অন্যদিকে সাংবাদিকরা কাইয়ুম চারুর কাছে মন্তব্য চাইলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে মারমুখী হয়ে ওঠেন এবং কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
কাজিরহাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, এ বিষয়ে থানায় কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি। তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু মানবাধিকারকর্মীরা প্রশ্ন তুলছেন—”একটি শিশুর ধর্ষণ, ভিডিও ফাঁস, গ্রামজুড়ে আলোচনা—এসবের পরও কেন পুলিশ নিজে থেকে ব্যবস্থা নেবে না?”
এই ঘটনাটি শুধু একটি শিশুর ক্ষতবিক্ষত জীবনের গল্প নয়, বরং গ্রামীণ সমাজে ন্যায়বিচারহীনতার এক নির্মম উদাহরণ। জনপ্রতিনিধিরা যখন অপরাধীকে রক্ষা করেন, প্রশাসন যখন চোখ বন্ধ করে থাকে, তখন সাধারণ মানুষ কাকে ভরসা করবে? ভাষানচরের এই ঘটনা প্রমাণ করেছে—আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া শিশু ও নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। মানবাধিকার কর্মী ও স্থানীয় সচেতন মহল জোর দাবি তুলেছেন—ভিকটিমকে দ্রুত উদ্ধার, অভিযুক্তসহ এই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার সাথে যারা জড়িত সকলকে গ্রেপ্তার এবং শালিসের নামে এই বিচারহীনতার অবসান ঘটাতে হবে।

























