
স্টাফ রিপোর্টার
ঢাকা, ১৫ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি দীর্ঘদিনের রোগ হিসেবে থেকে গেছে প্রতিহিংসার রাজনীতি। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধ্বংস বা দুর্বল করার প্রবণতা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপরও ফেলছে গভীর নেতিবাচক প্রভাব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “যে দেশে ক্ষমতা বদলের পর প্রতিহিংসা হয়ে ওঠে প্রধান এজেন্ডা, সেখানে উন্নয়নের অগ্রগতি টেকসই হতে পারে না।
প্রেক্ষাপট ও সংজ্ঞা:-প্রতিহিংসার রাজনীতি বলতে এমন এক রাজনৈতিক আচরণ বোঝায়, যেখানে ক্ষমতায় থাকা দল বা নেতৃত্ব তাদের প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে অচল করে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। এতে রাজনৈতিক বিরোধিতা সহিংসতা, মিথ্যা মামলা, প্রশাসনিক হয়রানি, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই প্রবণতা নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই প্রতিটি শাসনামলে বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীনদের দ্বারা মামলা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছে। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বছরগুলোর নির্বাচন-পরবর্তী বিরোধ পর্যন্ত প্রতিহিংসার রাজনীতির বহু নজির রয়েছে।
প্রতিহিংসার রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য:-
১. ক্ষমতার অপব্যবহার — সরকারি প্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন ও তদন্ত সংস্থাকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা।
২. মিথ্যা মামলা ও দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া — এমন মামলা করা যা বছরের পর বছর চলতে থাকে, প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে ব্যস্ত ও দুর্বল রাখে।
৩. সহিংসতা — সভা-সমাবেশে হামলা, সন্ত্রাস ও ভীতি প্রদর্শন।
৪. গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ — বিরোধী মতামত প্রচারকারী সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ, লাইসেন্স বাতিল বা মামলা।
৫. ব্যক্তিগত চরিত্র হনন — প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অপপ্রচার, কেলেঙ্কারি ছড়ানো।
উন্নয়নের পথে বড় বাধা:-
১. রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজের (BIPS) এক জরিপে দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গড়ে বছরে ৩৫ দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। হরতাল, অবরোধ ও সহিংসতার কারণে শিল্প উৎপাদন, রপ্তানি ও বিনিয়োগে বড় ধাক্কা লেগেছে।
২. বিদেশি বিনিয়োগে অনীহা
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (BIDA) ২০২৪ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনৈতিক সহিংসতা ও নীতি-অস্থিরতার কারণে প্রত্যাশিত বিদেশি বিনিয়োগের অন্তত ২৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়নি। বিনিয়োগকারীরা স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশকে প্রথম শর্ত হিসেবে বিবেচনা করেন।
৩. বিচারব্যবস্থার অবিশ্বাসযোগ্যতা
যখন আদালতকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন আইনের প্রতি জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ণ হয়। এতে আইনের শাসন দুর্বল হয় এবং দুর্নীতি বাড়ে।
৪. জনকল্যাণমূলক কাজের উপেক্ষা
প্রতিহিংসায় ব্যস্ত সরকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে মনোযোগ দিতে পারে না। বড় প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়, নীতি প্রণয়নে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দেয়।
বাস্তব উদাহরণ:-১৯৯০–২০০৮: এই সময়ে প্রায় প্রতিটি ক্ষমতা পরিবর্তনের পর বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও মামলা হয়েছে।
২০১৩–২০১৪: নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় শতাধিক মানুষ নিহত হয় এবং কয়েক বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়।
২০১৮–২০২৪: বিরোধী দলের অনেক শীর্ষ নেতা দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন, একই সঙ্গে সরকারপক্ষ দাবি করে—এগুলো দুর্নীতি ও সহিংসতার মামলার অংশ। বিরোধী পক্ষ একে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:-প্রতিহিংসার রাজনীতি গণতন্ত্রকে দুর্বল করে এবং জনগণের আস্থা নষ্ট করে। উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য, কিন্তু প্রতিহিংসা সেই স্থিতিশীলতার প্রধান শত্রু।
যেখানে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার প্রবণতা থাকে, সেখানে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে ওঠে। দলীয় স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক তুলনা:-সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া: রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও প্রতিহিংসামূলক গ্রেপ্তার বা সহিংসতা তুলনামূলকভাবে কম, ফলে তারা বিনিয়োগ আকর্ষণে সফল হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা: ৮০ ও ৯০-এর দশকে প্রতিহিংসার রাজনীতি ও গৃহযুদ্ধের কারণে অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকা: গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পর রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে প্রতিহিংসার প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে, যা তাদের উন্নয়নের জন্য সহায়ক হয়েছে।
সমাধানের পথ:-
১. রাজনৈতিক সংলাপ ও বোঝাপড়া — বিরোধী ও সরকার দলকে আলোচনার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব মেটাতে হবে।
২. স্বাধীন বিচারব্যবস্থা — বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে সাংবিধানিক নিশ্চয়তা প্রয়োজন।
৩. নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা — সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা বাড়ানো জরুরি।
৪. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা — সমালোচনামূলক সাংবাদিকতাকে দমন না করে গ্রহণ করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
৫. দলীয় প্রশিক্ষণ — তরুণ রাজনীতিবিদদের গণতন্ত্র, সহনশীলতা ও নৈতিকতার প্রশিক্ষণ দেওয়া।
বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই প্রতিহিংসার রাজনীতি উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে আছে। এটি কেবল রাজনীতিকদের মধ্যকার ক্ষমতার লড়াই নয়; বরং দেশের অর্থনীতি, সামাজিক সম্প্রীতি ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিহিংসা ত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, তবে উন্নয়নের গতি বহুগুণে বাড়তে পারে।